আজ ক্লাসে একটা আনন্দঘন পরিবেশ। সবাই বেশ ফুর্তিতে আছে। গতদিন খুশি আপা বলে দিয়েছিলেন আজ ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান ক্লাসের সময়ে বিদ্যালয়ের মাঠে বা যেখানে জায়গা পাওয়া যাবে সেখানে সবাই মিলে ফুটবল খেলা হবে। শ্রেণিকক্ষে সবাই অধীর আগ্রহে তাই খুশি আপার জন্য অপেক্ষা করছে। কেউ কেউ ব্যাগে করে প্রিয় খেলোয়াড়ের ছবিও নিয়ে এসেছে। একটু পর পর বের করে সবাইকে দেখাচ্ছে। এসবের মধ্যেই হাতে আস্ত একটা ফুটবল নিয়ে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি মুখে নিয়ে খুশি আপা ক্লাসে ঢুকে পড়লেন। সবার মাঝেই বিরাট এক উত্তেজনা।
হাতের ইশারায় সবাইকে থামিয়ে, খুশি আপা বললেন, কি সবাই প্রস্তুত? সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, প্রস্তুত আপা।
তাহলে এসো আমরা দুইটা দল গঠন করে ফেলি। প্রথমে আমরা সবাই মিলে চলো দুইজন অধিনায়ক ঠিক করে নেই। তারপর আমাদের দুই অধিনায়ক তাদের দলের অন্য খেলোয়াড়দের বাছাই করে নেবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে দল গঠনের সময় ছেলে-মেয়ে, বিশেষ চাহিদা সম্পন্নসহ সব ধরণের সক্ষমতার শিক্ষার্থীই কোনো না কোনো ভাবে যার যার সক্ষমতা অনুসারে খেলায় বা খেলার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে।
তখন শামীমা প্রস্তাব করলো যে, নীলা আর গণেশ হতে পারে দুই জন অধিনায়ক। অন্য দিকে মোজাম্মেল প্রস্তাব করলো যে ফ্রান্সিস আর রূপা হতে পারে দুই জন অধিনায়ক। সবাই চিহ্নিত হয়ে পড়লো তাহলে এই চারজনের মধ্য থেকে কোন দুই জন হতে পারে তাদের অধিনায়ক। অনুসন্ধান বলে উঠলো, আমরা ভোটের মাধ্যমে যে কোন দুই জনকে বাছাই করে নিতে পারি। তখন সবাই মিলে ভোট দিলো এবং ভোটে নীলা আর গণেশ দুই অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হলো। এরপর নীলা আর গণেশ অন্য খেলোয়াড়দের দলে যুক্ত করে তাদের দল গঠন সম্পন্ন করলো।
মাঠে গিয়ে খুশি আপা বললেন, আজ কিন্তু খেলা হবে অন্য রকমভাবে। আজ খেলায় কোন নিয়ম থাকবে না। খেলোয়াড়রা যে যেমন ইচ্ছা তেমন করেই খেলতে পারবে। শুনে দুই দলের খেলোয়াড়রাই মহা খুশি হয়ে উঠলো, এই ভেবে যে আজ আর গোলের হিসেব কেউ ঠিক করে রাখতে পারবে না। রেফারির দায়িত্ব পালন করছে তাদের ক্লাসেরই খাদিজা। খাদিজা বাঁশি বাঁজাতেই খেলা শুরু হয়ে গেল। তারপর ১৫ মিনিট ধরে তারা মহা উৎসাহের সাথে নিয়ম ছাড়া ফুটবল খেলার চেষ্টা করলো। তারপর খুশি আপা নিয়ন ছাড়া খেলার পর্ব শেষ করলেন। এবার তিনি বললেন, এসো আমরা নিয়ম অনুযায়ী ফুটবল খেলি। তারপর তারা আবার নিয়ম- কানুন মেনে ফুটবল খেললো।
নীলা ও গণেশ এর দলের মতো চলো আমরাও ক্লাসের বন্ধুদের সাথে দুই দলে বিভক্ত হয়ে ফুটবল খেলি |
---|
নিয়ম ছাড়া কোনো কিছুই কাজ করে না।
পরদিন ক্লাসে সবাই উত্তেজিত হয়ে ফুটবল খেলা নিয়ে আলোচনা করছিল। খুশি আপা এসে বললেন, কাল যে আমরা ফুটবল খেললাম সেটা তোমাদের কেমন লেগেছে? সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, খুবই ভালো!
খুশি আপা তখন বললেন, গতকাল আমরা দুই ভাবে ফুটবল খেলেছি, তাতে খেলায় কি কোনো পার্থক্য তৈরি হয়েছে? চিংময় বললো, আমিতো ভেবেছিলাম নিয়ম ছাড়া ফুটবল খেলার সময় এত গোল হবে যে কোন হিসেব রাখা যাবে না। কারণ সবাই হাত দিয়েই গোল দেবে। খাদিজা বললো, অথচ কোন দলই একটাও গোল দিতে পারে নি। কোন নিয়ম ছাড়াই খেলতে গিয়ে একজন যখন বল হাতে নিয়ে দৌড় দিয়েছে অন্যরা তার উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। ফলে একজায়গায় জটলা পাকিয়ে কেউ কোনো দিকে যেতে পারে নি। বারবার এই একই পরিস্থিতি তৈরি হওয়াতে নির্ধারিত সময়ে আর কেউ গোল করতে পারে নি। আসলে নিয়ম ছাড়া খেলাটাই শেষ পর্যন্ত আমরা খেলতে পারি নি। চলো এবার আমরা ৫/৬ জনের গ্রুপে বসে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করি।
এরপর দলগুলো নিজেদের ফলাফল বোর্ডে বা পোস্টার পেপারে লিখে একটি তালিকা তৈরি করলো এবং উন্মুক্ত আলোচনা শেষে সবাই উপলব্ধি করে যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই নিয়ম এবং নিয়ম মানার গুরুত্ব অপরিসীম। তাদের শ্রেণিকক্ষ, বিদ্যালয়, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্রই নিয়মের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এবার চলো আমরাও বন্ধুদের সাথে মিলে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করি — নিয়ম কি শুধু খেলাতেই থাকে?
উত্তর:………………………………………………………………………………………………………………
আর কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা নিয়ম দেখতে পাই? চলো তার একটি তালিকা তৈরি করি।
উত্তর:..…………………………………………………………………………………………………………………….
কোথায় কী ধরণের নিয়ম রয়েছে?
উত্তর:……………………………………………………………………………………………………………..
নিয়ম না থাকলে ঐসব ক্ষেত্রে কী ধরণের সমস্যা হতে পারে?
উত্তর:……………………………………………………………………………………………………………..
এ পর্যায়ে শামিমা বললো, আচ্ছা, এবার বুঝেছি কেন আমাদের শ্রেণিকক্ষে, দিনের শুরুতে বিদ্যালয়ে ঢোকার সময় টিফিনের সময়, ছুটির সময়সহ বিভিন্ন সময়ে মাঝে মাঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কারণ, এসব ক্ষেত্রে আমরা নিয়ম মেনে চলি না। স্বাধীন বললো, তাহলে তো আমাদের শ্রেণিকক্ষ, বিদ্যালয়, পরিবার এবং সমাজে আচার-আচরণের নিয়ম তৈরি করা প্রয়োজন। এরপর তারা দলে ভাগ হয়ে শ্রেণিকক্ষে ও বিদ্যালয়ে নিজেরা পালনের নীতিমালা তৈরি করলো এবং তা শ্রেণিকক্ষে দৃশ্যমানভাবে টাঙিয়ে দিল। তাদের প্রস্তুতকৃত নীতিমালাসমূহের নমুনা নিচে দেওয়া হলো।
শ্রেণিকক্ষে অনুসরণের নিয়মের নমুনা:
১. পরিচিত কারও সাথে দেখা হলে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করব
২. অন্যের মতামতের ব্যাপারে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবো।
৩. কেউ যখন কথা বলবে অন্যরা ধৈর্য সহকারে শুনবো
৪. নিজের মতামত দেওয়ার আগে হাত তুলে অনুমতি নেবো
৫. কোন বিষয়ে বিরোধ হলে একসাথে বসে আলোচনা করে মীমাংসা করবো
বিদ্যালয়ে অনুসরণের জন্য নিয়মের নমুনা:
১. বিদ্যালয়ে প্রবেশ ও বাহিরে যাবার সময় ধৈর্যের সাথে লাইনে দাঁড়াবো।
২. বিদ্যালয় কোনো ভাবেই অপরিচ্ছন্ন করবো না
৩. বিদ্যালয় পরিষ্কার রাখতে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করবো
পরিবারে ও সমাজে অনুসরণের জন্য নিয়মের নমুনা:
১. নিজের কাজ নিজে করবো
২. অন্যের সমস্যা বা ক্ষতি হয় এমন কাজ করবো না
৩. নতুন মানুষের সাথে কথা বলার সময় আগে নিজের পরিচিয় দেব। এর পর অনুমতি নিয়ে বিনয়ের সাথে কথা বলব।
৪. ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ, বিত্ত ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করব এবং ছোটদের স্নেহ ও ভালোবাসা দেব।
৫. রাস্তায়, হাটে-বাজারে ও যেকোনো সমাবেশে এমনভাবে চলব যাতে অপরের চলাচলের কোনো সমস্যা না হয়। অপ্রয়োজনে কোথাও ভিড় বাড়াব না।
তারা ঠিক করলো যে, সারা বছর নিয়মগুলো তারা মেনে চলবে। যদি নতুন কোনো নিয়ম যুক্ত করার প্রয়োজন হয় তবে শ্রেণিকক্ষে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে তা যুক্ত করা যাবে। একইভাবে কোনো নিয়ম অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেলে তা বাদ দেওয়া যাবে। যত দিন তারা বিদ্যালয়ে থাকবে ততদিন পরবর্তী ক্লাসগুলোতেও এই নিয়মগুলো, প্রয়োজনে কিছু সংশোধন করে, তারা অনুসরণ করতে পারবে। খুশি আপা আনন্দের সাথে জানালেন যে, তিনিও সবার সাথে এই নিয়মগুলো মেনে চলবেন।
আদনান তখন বললো, কিন্তু বিদ্যালয়ে ও সমাজে তো আমরা শুধু একাই বাস করি না। আরো অনেক ধরণের মানুষ বাস করে। সবাই তো বিদ্যালয়ে এসব নিয়ম শেখার সুযোগ পায় নি। তারাও যদি নিয়ম মেনে না চলে তাহলে তো বিশৃঙ্খলা দূর হবে না। কিন্তু এত মানুষকে নিয়ম পালনে উদ্বুদ্ধ করা খুবই কঠিন কাজ। এটা একা একা করা আমাদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। আনুচিং বললো, চল তাহলে আমরা একটি ক্লাব তৈরি করি। সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য ক্লাব।
সবাই তার এ চিন্তাটাকে সমর্থন করলো। রবিন বললো, তাহলে আমাদের ক্লাবের নাম হতে পারে সক্রিয় নাগরিক ক্লাব।
এ পর্যায়ে খুশি আপা নিচের ছবিগুলো সবাইকে দেখিয়ে নিচের তার কোনগুলো নিয়ম মেনে চলার আর কোনগুলো নিয়ম ভাঙার তা আলোচনা করতে বলবেন।
ছবি নিয়ে আলোচনা শেষ হলে তিনি বললেন যে, এগুলো তো শুধু ট্রাফিক নিয়ম মানা না মানার চিত্র। এসব ছাড়াও কাজের আরো অনেক ক্ষেত্র রয়েছে।
এরপর শিক্ষার্থীরা ৫/৬ জনের দলে ভাগ হয়ে আমাদের সক্রিয় নাগরিক ক্লাবের কাজ কী হবে তার তালিকা তৈরি করলো। প্রতিটি দলের তালিকা উপস্থাপনের পর আলোচনার মাধ্যমে সবার সম্মতিতে ক্লাবের কাজ কী হবে তা শিক্ষার্থীরা চূড়ান্ত করে ফেললো।
তিনি আরো বললেন, কী কাজ করবো তা তো ঠিক করা হলো, চলো এবার আমরা এই কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করার সুবিধার্থে ক্লাবের একটি কমিটি গঠন করি। শিক্ষার্থীরা দলে বসে কমিটি সম্পর্কিত নিচের বিষয়গুলো আলাচনা করলো-
এগুলোর ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা প্রস্তাবনা তৈরি করলো এবং দলগতভাবে উপস্থাপন করলো। সবাই মিলে। আলোচনা করে একটা সাধারণ কাঠামো এবং অধিকার ও দায়িত্বের বিবরণী তারা তৈরি করলো। কমিটিতে। তারা ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষককে উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলো।
এরপর শিক্ষার্থীরা নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের কমিটি গঠন সম্পন্ন করলো। নতুন কমিটি দ্রুতই তাদের প্রথম মিটিংয়ের তারিখ নির্ধারণ করে এবং প্রথম সভাতেই তারা পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করে।
সক্রিয় নাগরিক ক্লাবের প্রথম কার্যক্রম হিসেবে খুশি আপা ট্রাফিক আইন নিয়ে ভাবার প্রস্তাব করলেন। শিক্ষার্থীরা সম্মত হলে তিনি সবাইকে তিনটি দলে বিভক্ত হবার আহ্বান জানান।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী-
একাজে তারা আগে থেকেই তৈরি করে রাখা সবুজ, হলুদ ও লাল রংয়ের কাগজের বোর্ড বা অন্য যে কোন উপযুক্ত মাধ্যম ব্যবহার করে সিগন্যাল বাড়ি বানিয়ে রেখেছিলো। এ কাজে স্কুলের মাঠ বা উঠান ব্যবহার করব। শিক্ষকের সহায়তায় তারা প্রদর্শনীর দিনের আগেই এই খেলার পরিকল্পনা ও রিহার্সেল (মহড়া) করেছিলো। |
---|
একটি সড়ক দুর্ঘটনা, বাজারের একটি দিন বা আসা-যাওয়ার পথে- এইসব বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষক বা উপযুক্ত কারও সহায়তায় নাটক আয়োজন করলো। প্রস্তুতির সময় ট্রাফিক বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তাদের সহযোগিতা করেছিলেন। কমিটির সদস্যরা খুশি আপা প্রধান ও শিক্ষকের সহায়তায় তাঁর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।
চলো বন্ধুদের সাথে নিয়ে আমরাও একটি সক্রিয় নাগরিক ক্লাব গড়ে তুলি এবং আমাদের কার্যক্রম শুরি করি। |
---|
এবার চলো আমরা নিচে যুক্ত আত্মমূল্যায়নের ছকের মাধ্যমে আমাদের সক্রিয় নাগরিক ক্লাবের সাথে আমাদের কার্যক্রমের মূল্যায়ন করি।
আত্মমূল্যায়নের ছক (শিক্ষার্থী নিজে পূরণ করবে)
ক্রম | ক্লাব কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পর | সম্পূর্ণ একমত | মোটামুটি একমত | একমত নয় |
---|---|---|---|---|
১ | অন্তত: দুটি সক্রিয় নাগরিকের গুণাবলি অর্জন করেছি | |||
২ | গণতান্ত্রিক আচরণ শিখেছি | |||
৩ | ভোটের পদ্ধতি সম্পর্কে জেনেছি | |||
৪ | ক্লাবের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে আনন্দ পেয়েছি | |||
৫ | সমাজে একজন সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। | |||
৬ | সক্রিয় নাগরিকসুলভ অন্তত পক্ষে দুটি কাজ করেছি/শুরু করেছি | |||
৭ | আমি বিশ্বাস করি আমার কাজে ক্লাব উপকৃত হয়েছে |
আরও দেখুন...